সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০৬:৪৩ পূর্বাহ্ন

আমেরিকার ব্যর্থতাসমগ্র

স্বদেশ ডেস্ক:

মার্কিন প্রশাসনের নির্দেশনায় যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যরা এখন পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ করেছে। ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা’, ‘সন্ত্রাসবাদ’, ‘জঙ্গিবাদ’ প্রতিরোধ বা ‘গণতন্ত্র উদ্ধার’ ইত্যাদি অজুহাতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মাটিতে মার্কিন সেনার বুটের ছাপ পড়েছে। কিন্তু পরাজয়ের গ্লানি স্বীকার করে কফিন ঘাড়ে ফিরে আসতে হয়েছে মার্কিনিদের। মার্কিন পরাজয় নিয়ে জানাচ্ছেন- শামস্ বিশ্বাস

ভিয়েতনাম যুদ্ধ

(ভিয়েতনাম) ১৯৫৫-৭৫

ভিয়েতনাম যুদ্ধ দ্বিতীয় ইন্দোচীন যুদ্ধ নামেও পরিচিত। ভিয়েতনামে এটি আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ বা সহজভাবে আমেরিকান যুদ্ধ। এটি ১৯৫৫ সালের ১ নভেম্বর থেকে ১৯৭৫ সালের ৩০ এপ্রিলে সাইগনের পতন পর্যন্ত ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়ায় চলাকালীন সংঘাত। সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন ও অন্যান্য কমিউনিস্ট মিত্রদেশ উত্তর ভিয়েতনামকে সমর্থন করেছিল। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড ও অন্যান্য কমিউনিস্টবিরোধী মিত্রদেশ দক্ষিণ ভিয়েতনামকে সমর্থন করেছিল। কারও কারও কাছে এই যুদ্ধ, ¯œায়ুযুদ্ধ যুগের প্রক্সি যুদ্ধ হিসেবে বিবেচিত। তা ১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ জড়িত থাকার মধ্য দিয়ে ১৯ বছর ৫ মাস ধরে চলেছিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলাকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন যথাক্রমে ডোয়াইট ডি আইজেনহাওয়ার, জন এফ কেনেডি, লিন্ডন বি জনসন, রিচার্ড নিক্সন ও জেরাল্ড ফোর্ড। এই যুদ্ধ মার্কিন ইতিহাসের এক ব্যর্থ যুদ্ধ। এ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ৮৪৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় হয় এবং নিহত হয় ৫৮ হাজার সেনা।

লেবাননে বহুজাতিক বাহিনী

(লেবানন) ১৯৮২-৮৪

১৯৭৫ সাল থেকে শুরু হওয়া লেবাননে গৃহযুদ্ধের একপর্যায়ে ১৯৮২ সালে ফিলিস্তিনি ও সিরীয়দের খেদাওয়ের নামে ইসরায়েল সামরিক বাহিনী নিয়ে লেবাননে ঢুকে পড়ে। ১৯৮২ সালে পিএলওকে জর্দানে সরিয়ে দেওয়ার পর মার্কিন ও ইউরোপীয় বাহিনী লেবানন থেকে চলে যায়। কিন্তু বোমা বিস্ফোরণে লেবাননি প্রেসিডেন্ট বসির গেমায়েল নিহত হওয়ার পর তারা আবার ফিরে আসে। গেমায়েলের ম্যারোনাইট খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ফালাঞ্জি মিলিশিয়া এই হত্যার দায় ফিলিস্তিনদের কাঁধে চাপিয়ে ইসরায়েলি বাহিনীর চোখের সামনে শত শত বেসামরিক ফিলিস্তিনকে হত্যা করে। ১৯৮৩ সালের মে মাসে আমেরিকার উদ্যোগে লেবানন ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি স্বল্পস্থায়ী সমঝোতা হয়। এর মধ্য দিয়েই আমেরিকা লেবানন যুদ্ধে আরও গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৮২ সালে ইরানের বিপ্লবী গার্ড প্রতিরক্ষা বাহিনী লেবাননে শিয়াপন্থি হিজবুল্লাহকে সংগঠিত করে। ১৯৮৩ সালে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়ে লেবাননের বৈরুতে মার্কিন সামুদ্রিক সদর দপ্তর ধ্বংস করে হিজবুল্লাহ। ওই হামলায় ২৪১ কর্মকর্তা নিহত হন। ওই বছরই লেবানন থেকে মার্কিন সেনা সরিয়ে নেওয়া হয়। এই সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন যথাক্রমে জিমি কার্টার ও রোনাল্ড রিগ্যান।

অপারেশন গোথিক সার্পেন্টের

(সোমালিয়া) ১৯৯৩

১৯৯৩ সালে ভিয়েতনামের পর সোমালিয়ায় শত্রুপক্ষের কাছে নাস্তানাবুদ হয়েছিল মার্কিন সেনারা। সোমালিয়ার গৃহযুদ্ধে ১৯৯২ সালে প্রথমবারের মতো আমেরিকা নজর দেয়। তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন জর্জ বুশ। জাতিসংঘের মানবিক সাহায্যের সর্বোচ্চ নিরাপত্তার উদ্দেশে যুক্তরাষ্ট্র ‘অপারেশন রিস্টোর হোপ’ পরিচালনা করে। এটি ছিল একটি জয়েন্ট কমান্ড মিলিটারি মিশন। ১৯৯৩ সালের ৩ ও ৪ অক্টোবর মোগাদিশুতে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। যুদ্ধের এক পক্ষে ছিলের তৎকালীন সোমালিয়ার প্রেসিডেন্ট ও মিলিশিয়াদের নেতা যুদ্ধবাজ মোহাম্মদ ফারাহ এইদিদ। যুদ্ধটি মোগাদিশুর প্রথম যুদ্ধ নামেও পরিচিত।

ইরাক যুদ্ধ

(ইরাক) ২০০৩-১১

ইরাক যুদ্ধ মার্কিন অপারেশন ইরাকি ফ্রিডম নামেও পরিচিত। ২০০৩ সালের ২০ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পরিচালিত বাহিনীর ইরাক আগ্রাসনের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। এই আগ্রাসী বাহিনীতে অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, পোল্যান্ড ও অন্যান্য কয়েকটি জাতির সৈন্য দল অংশ নিয়েছিল। ইরাক আক্রমণ করার জন্য তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ও কোয়ালিশন বাহিনী যে কারণ দেখিয়েছিল, তা হলো ইরাক ১৯৯১ সালের চুক্তি অমান্য করে গণবিধ্বংসী অস্ত্র নির্মাণ করছে এবং তাদের কাছে এ ধরনের অস্ত্রের মজুদও আছে। তখন সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, ইরাক যুক্তরাষ্ট্র, এর জনগণ ও মিত্র রাষ্ট্রগুলোর জন্য বড় ধরনের হুমকি। পরে পরিদর্শকরা ইরাকে গিয়ে কোনো ধরনের গণবিধ্বংসী অস্ত্র খুঁজে পায়নি। তারা জানান, ইরাক ১৯৯১ সালেই গণবিধ্বংসী অস্ত্র নির্মাণ ত্যাগ করেছে। ইরাকের ওপর থেকে আন্তর্জাতিক অনুমোদন সরিয়ে নেওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের নতুন করে গণবিধ্বংসী অস্ত্র নির্মাণের কোনো পরিকল্পনাও ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে ইরাকে হামলা চালায়।

ইরাকের এ সংঘাতের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে প্রায় এক ট্রিলিয়নের বেশি মার্কিন ডলার ব্যয় করতে হয়। দেশটি এখনো সংঘাত ও সন্ত্রাসের ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত। জর্জ ডব্লিউ বুশে শুরু করা এই যুদ্ধ চলে ২০১১ সালে বারাক ওবামার সেনা প্রত্যহার পর্যন্ত। ৮ বছর ৯ মাসব্যাপী এ যুদ্ধে ৪ হাজার ৪১০ মার্কিন সেনা মারা যায়। ইরাকের গৃহযুদ্ধ (২০১৩-১৭) এবং ইসলামিক স্টেট (আইএস) দমনে ২০১৪ সালে আবার মার্কিন বাহিনী ফিরে আসে ইরাকে।

আফগান যুদ্ধ

(আফগানিস্তান) ২০০১-২১

২০০১ সালে শুরু হয় আফগান যুদ্ধ। জর্জ ডব্লিউ বুশ শুরু করা এই যুদ্ধ বারাক ওবামা, ডোনাল্ড ট্রাম্পের পর জো বাইডেনের সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণার মাধ্যমে শেষ হয়। ২০০১ সালে ওসামা বিন লাদেনের নেতৃত্বে আল কায়েদা হামলা চালিয়েছেÑ এমন অভিযোগে আফগান সরকারের কাছে লাদেনকে হস্তান্তর করার আহ্বান জানায়। তালেবান প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। ২০০১ সালের হামলার পর থেকে ১৯ বছর ১০ মাসে আফগানিস্তানে যুদ্ধে মার্কিন ও মিত্রবাহিনীর ৩ হাজার ৫৮৬ জন নিহত হয়। পুলিশ ও সেনাসদস্যের মৃত্যু হয়েছে ৭৫ হাজার ৯৭১ জনের। বেসামরিক মানুষ নিহত হয় ৭৮ হাজার ৩১৪ জন। আর তালেবানসহ সরকারবিরোধী যোদ্ধা নিহত হওয়ার সংখ্যা ৮৪ হাজার ১৯১।

সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (সিআইএ)

সিআইএ যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের আওতাধীন একটি বেসামরিক গোয়েন্দা সংস্থা। এটি একটি স্বাধীন সংস্থা। এ সংস্থার দায়িত্ব যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং উচ্চপদস্থ নীতিনির্ধারকদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করা। ১৯৪৭ সালে অনুমোদিত হওয়া ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বা জাতীয় নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে সিআইএ গঠন করা হয়। সিআইএর প্রাথমিক কাজ হচ্ছে বিদেশি সরকার, সংস্থা ও ব্যক্তিদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা এবং তা জাতীয় নীতিনির্ধারকদের কাছে সরবরাহ ও পরামর্শ প্রদান করা।

দেশে দেশে মার্কিন নৃশংসতা

ইরান (১৯৫৩) : সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সিআইএ ইরানে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত জাতীয়তাবাদী প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে উৎখাত করে। তার স্থলাভিষিক্ত ইরানের শাহের গোপন পুলিশ বাহিনী ছিল গেস্টাপোর মতোই নৃশংস।

গুয়াতেমালা (১৯৫৪-৫৮) : সিআইএ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত জ্যাকব আরবেঞ্জ গুজম্যানের সংস্কারবাদী সরকারকে উৎখাত করে। পরবর্তী ৪০ বছর স্বৈরশাসকদের স্বৈরশাসনে প্রাণ দিতে হয়েছিল এক লাখেরও বেশি গুয়েতেমালানকে।

লাওস (১৯৫৭-৭৩) : গণতান্ত্রিক নির্বাচন বাতিল করতে প্রায় প্রতিবছর একটি করে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করত সিআইএ। দেশটির অধিবাসীদের ৪ ভাগের ১ ভাগ হয়ে পড়ে শরণার্থী।

হাইতি (১৯৫৭) : মার্কিন সমর্থনে সামরিক বাহিনীর সহযোগিতায় রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন ফ্রাঙ্কোইস ‘পাপা ডক’ ডুভেলিয়ার। ডুভেলিয়ার পারিবারের ব্যক্তিগত পুলিশ বাহিনী ‘টনটন ম্যাকোটস’ এক লাখেরও বেশি মানুষকে হত্যা করে।

ইকুয়েডর (১৯৬১) : সিআইএ সমর্থিত সামরিক শক্তির কারণে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ইকুয়েডরের প্রেসিডেন্ট জোস ভেলাসকো।

কঙ্গো (১৯৬১) : স্বাধীন গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও আফ্রিকার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতা প্যাট্রিস লুলুম্বাকে গোপনে হত্যা করে সিআইএ।

ব্রাজিল (১৯৬৪) : সিআইএ সমর্থিত সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার জোয়াও গৌলার্ত।

ইন্দোনেশিয়া (১৯৬৫) : সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ইন্দোনেশিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট এবং দেশটির জাতির পিতা সুকর্ণকে উৎখাত করে সিআইএ।

গ্রিস (১৯৬৫) : সিআইএর ইচ্ছায় প্রধানমন্ত্রী জর্জ প্যাপানড্রিয়াসকে পদচ্যুত করেন গ্রিসের শেষ রাজা দ্বিতীয় কনস্টেন্টাইন। পরবর্তী ছয় বছর সিআইএ সমর্থিত সামরিক বাহিনীর কর্রেলদের শাসনে রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর চালানো হয় নির্যাতন ও হত্যা।

কম্বোডিয়া (১৯৭০) : সিআইএ কম্বোডিয়ায় জনগণের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় প্রিন্স সাহৌনেককে উৎখাত করে তার স্থলাভিষিক্ত করে লন নল কে। ফলে খেমাররুজ দলগুলো ১৯৭৫ সালে ক্ষমতায় এসে লাখো জনগণকে বেপরোয়াভাবে হত্যা করে।

বলিভিয়া (১৯৭১) : সিআইএ প্ররোচিত রাজনৈতিক হাঙ্গামার অর্ধদশক পর তাদের সমর্থিত সামরিক অভ্যুত্থানে উৎখাত করা হয় বামপন্থি প্রেসিডেন্ট জুয়ান টরেসকে।

চিলি (১৯৭৩) : লাতিন আমেরিকার প্রথম নির্বাচিত সমাজতান্ত্রিক নেতা সালভেদর এলেন্ডেকে উৎখাত করার পর হত্যা করে সিআইএ।

অস্ট্রেলিয়া (১৯৭৫) : গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বামপন্থি সরকারের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হুইটলামকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সহায়তা করে সিআইএ।

পানামা (১৯৮৯) : ১৯৬৬ সাল থেকে সিআইএর হয়ে কাজ করা নিজেদের সমর্থিত সেনাশাসক জেনারেল ম্যানুয়েল নরিয়েগাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পানামা আক্রমণ করে যুক্তরাষ্ট্র।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877